Saturday, March 5, 2016

সেরা ছড়া ও কবিতা-১


কাজী নজরুল ইসলাম
চল চল চল!
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণি তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল
চল চল চল।
ঊষার দুয়ারে হানি' আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,
আমরা টুটাব তিমির রাত,
বাধার বিন্ধ্যাচল
নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মশান,
আমরা দানিব নতুন প্রাণ
বাহুতে নবীন বল!
চল রে নও-জোয়ান,
শোন রে পাতিয়া কা-
মৃত্যু-তরণ-দুয়ারে দুয়ারে
জীবনের আহবান।
ভাঙ রে ভাঙ আগল,
চল রে চল রে চল
চল চল চল।
ঊর্ধ্ব আদেশ হানিছে বাজ,
শহীদী-ঈদের সেনারা সাজ,
দিকে দিকে চলে কুচ-কাওয়াজ-
খোল রে নিদ-মহল!
কবে সে খেয়ালী বাদশাহী,
সেই সে অতীতে আজো চাহি'
যাস মুসাফির গান গাহি'
ফেলিস অশ্রুজল
যাক রে তখত-তাউস
জাগ রে জাগ বেহুঁস।
ডুবিল রে দেখ কত পারস্য
কত রোম গ্রীক রুশ,
জাগিল তা'রা সকল,
জেগে ওঠ হীনবল!
আমরা গড়িব নতুন করিয়া
ধুলায় তাজমহল!
চল চল চল।
. মনিরুজ্জামান
আমারও দেশের মাটির গন্ধে
ভরে আছে সারা মন
শ্যামল কোমল হরষ ছাড়া যে
নেই কিছু প্রয়োজন
প্রানে প্রানে যেন তাই
তারই সুর শুধু পাই
দিগন্ত জুড়ে সোনা রঙ ছবি
এঁকে যাই সারাক্ষন
বাতাস আমার সবুজ স্বপ্নে দুলছে
কন্ঠে কন্ঠে তারই ধ্বনি শুধু
তুলছে

গানে গানে আজই তাই
সেই কথা বলে যাই
নতুন আশার এনেছে জীবনে
সূর্যেরই লগন।।

আয়রে আয় ঘুম আয় - বাংলায় গানের কথা |

banglasonglyrics.com/9146/আয়রে-আয়-ঘুম-আয়/
Oct 29, 2013 –
আয়রে আয় ঘুম আয়
আমার বাপির চোখে নেমে আয়।।
(হায় রে এক দুখিনী মায়ের অশ্রু ভরে যায়
নিস্প্রান পথের ধুলায় দীর্ঘ্য নিশ্বাষ রেখে যায়,
আয় রে ফিরে আয়)
ঘুমপরীগো দেবো তোরে মুক্তো হীরের গয়না গড়ে
একটুখানি বসে যাবি দুষ্ট চোখের ছায়।।
(কেউ খুজে পায় কেউ বা না পায়
কেউ বা আবার পেয়েও হারায় এই কী পৃথিবীর ...

আমাদের গ্রামবন্দে আলী মিয়া

আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর৷
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,
এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই৷
আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ৷
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি৷
আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন,
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন৷
সকালে সোনার রবি পুব দিকে ওঠে,
পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে৷
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে
পার হয়ে যায় গোরুপার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তারঢালু তার পাড়ি।


চিক্ চিক্ করে বালিকোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।


আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাহিবার কালে
গামছায় জল ভরে গায়ে তারা ঢালে।


সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচলে ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে
বালি দিয়ে মাজে থালাঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।


আষাঢ়ে বাদল নামেনদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে

দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মাস্টার বাবু
আমি আজ কানাই মাস্টার,
বড় মোর বেড়াল ছানাটি
আমি ওকে মারি নে মা বেত,
মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি
রোজ রোজ দেরি করে আসে,
পড়াতে দেয় না তো মন,
ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই,
যত আমি বলি 'শোন, শোন'
দিনরাত খেলা খেলা খেলা,
লেখা পড়ায় ভারি অবহেলা
আমি বলি ' '
কেবল বলে 'মিয়ো, মিয়ো'
প্রথম ভাগের পাতা খুলে
আমি ওরে বোঝাই মা কত-
চুরি করে খাস নে কখনে,
ভাল হোস গোপালের মতো
যত বলি সব হয় মিছে,
কথা যদি একটাও শোনে-
মাছ যদি দেখেছে কোথাও
কিছুই থাকে না আর মনে
চড়াই পাখির দেখা পেলে
ছুটে যায় সব পড়া ফেলে
যত বলি ' '
দুষ্টামি করে বলে 'মিয়ো'
আমি ওরে বলি বার বার
'পড়ার সময় তুমি পড় -
তার পরে ছুটি হয়ে গেলে
খেলার সময় খেলা কোরো'
ভাল মানুষের মত থাকে,
আড়ে আড়ে চায় মুখপানে,
এমনি সে ভান করে যেন
যা বলি বুঝেছে তার মানে
একটু সুযোগা বোঝে যেই
কোথা যায় আর দেখা নেই
আমি বলি ' ',
কেবল বলে 'মিয়ো মিয়ো'।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তালগাছ

তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে
মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়,
একেবারে উড়ে যায়;
কোথা পাবে পাখা সে?
তাই তো সে ঠিক তার মাথাতে
গোল গোল পাতাতে
ইচ্ছাটি মেলে তার, -
মনে মনে ভাবে, বুঝি ডানা এই,
উড়ে যেতে মানা নেই
বাসাখানি ফেলে তার
সারাদিন ঝরঝর থত্থর
কাঁপে পাতা-পত্তর,
ওড়ে যেন ভাবে ,
মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে
তারাদের এড়িয়ে
যেন কোথা যাবে
তার পরে হাওয়া যেই নেমে যায়,
পাতা কাঁপা থেমে যায়,
ফেরে তার মনটি
যেই ভাবে, মা যে হয় মাটি তার
ভালো লাগে আরবার
পৃথিবীর কোণটি
আত্মত্রাণ

বিপদে মোরে রক্ষা করো
নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে
নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়
সহায় মোর না যদি জুটে
নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি
লভিলে শুধু বঞ্চনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়
আমারে তুমি করিবে ত্রাণ
নহে মোর প্রার্থনা,
তরিতে পারি শকতি যেন রয়
আমার ভার লাঘব করি
নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
বহিতে পারি এমনি যেন হয়
নম্রশিরে সুখের দিনে
তোমারি মুখ লইব চিনে,
দুখের রাতে নিখিল ধরা
যেদিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয়

জুতা-আবিষ্কাররবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কহিলা হবু, ‘শুন গো গোবুরায়,
কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র
মলিন ধূলা লাগিবে কেন পায়
ধরণীমাঝে চরণফেলা মাত্র!
তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি,
রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি।
আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি,
রাজ্যে মোর একি অনাসৃষ্টি!
শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার,
নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর।
শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হল খুন,
দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে।
পণ্ডিতের হইল মুখ চুন,
পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে।
রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি,
কান্নাকাটি পড়িল বাড়িমধ্যে,
অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি
কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে,
যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে,
পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে!’
শুনিয়া রাজা ভাবিল দুলি দুলি,
কহিল শেষে, ‘কথাটা বটে সত্য
কিন্তু আগে বিদায় করো ধুলি,
ভাবিয়ো পরে পদধুলির তত্ত্ব।
ধুলাঅভাবে না পেলে পদধুলা
তোমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে,
কেন বা তবে পুষিনু এতগুলা
উপাধিধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যে?
আগের কাজ আগে তো তুমি সারো,
পরের কথা ভাবিয়ো পরে আরো।
আঁধার দেখে রাজার কথা শুনি,
যতনভরে আনিল তবে মন্ত্রী
যেখানে যত আছিল জ্ঞানীগুণী
দেশে বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী।
বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি,
ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য।
অনেক ভেবে কহিল, ‘গেলে মাটি
ধরায় তবে কোথায় হবে শস্য?’
কহিল রাজা, ‘তাই যদি না হবে,
পণ্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে?’
সকলে মিলি যুক্তি করি শেষে
কিনিল ঝাঁটা সাড়ে সতেরো লক্ষ,
ঝাঁটের চোটে পথের ধুলা এসে
ভরিয়ে দিল রাজার মুখ বক্ষ।
ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ,
ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূর্য।
ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক,
ধুলার মাঝে নগর হল উহ্য।
কহিল রাজা, ‘করিতে ধুলা দূর,
জগৎ হল ধুলায় ভরপুর!’
তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক
মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি।
পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক,
নদীর জলে নাহিক চলে কিস্তি।
জলের জীব মরিল জল বিনা,
ডাঙার প্রাণী সাঁতার করে চেষ্টা
পাঁকের তলে মজিল বেচাকিনা,
সর্দিজ্বরে উজাড় হল দেশটা।
কহিল রাজা, ‘এমনি সব গাধা
ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা!’
আবার সবে ডাকিল পরামর্শে;
বসিল পুন যতেক গুণবন্ত
ঘুরিয়া মাথা হেরিল চোখে সর্ষে,
ধুলার হায় নাহিক পায় অন্ত।
কহিল, ‘মহী মাদুর দিয়ে ঢাকো,
ফরাশ পাতি করিব ধুলা বন্ধ।
কহিল কেহ, ‘রাজারে ঘরে রাখো,
কোথাও যেন থাকে না কোনো রন্ধ্র।
ধুলার মাঝে না যদি দেন পা
তা হলে পায়ে ধুলা তো লাগে না।
কহিল রাজা, ‘সে কথা বড়ো খাঁটি,
কিন্তু মোর হতেছে মনে সন্ধ,
মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
দিবসরাতি রহিলে আমি বন্ধ।
কহিল সবে, ‘চামারে তবে ডাকি
চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী।
ধূলির মহী ঝুলির মাঝে ঢাকি
মহীপতির রহিবে মহাকীর্তি।
কহিল সবে, ‘হবে সে অবহেলে,
যোগ্যমতো চামার যদি মেলে।
রাজার চর ধাইল হেথা হোথা,
ছুটিল সবে ছাড়িয়া সব কর্ম।
যোগ্যমতো চামার নাহি কোথা,
না মিলে তত উচিতমতো চর্ম।
তখন ধীরে চামারকুলপতি
কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,
বলিতে পারি করিলে অনুমতি,
সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ।
নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।
কহিল রাজা, ‘এত কি হবে সিধে,
ভাবিয়া সকল দেশশুদ্ধ!’
মন্ত্রী কহে, ‘বেটারে শূল বিঁধে
কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।
রাজার পদ চর্মআবরণে
ঢাকিল বুড়া বসিয়া পদোপান্তে।
মন্ত্রী কহে, ‘আমারো ছিল মনে
কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।
সেদিন হতে চলিল জুতা পরা
বাঁচিল গোবু, রক্ষা পেল ধরা
জসীমউদদীন

খুকির সম্পত্তি

শিউলি নামের খুকির সনে আলাপ আমার অনেক দিনের থেকে
হাসিখুশি মিষ্টমিশি অনেক কথা কই যে তারে ডেকে
সেদিন তার কইনু 'খুকি- কী কী জিনিস কওতো তোমার আছে?
সগৌরবে বলল, অনেক-অনেক কিছু আছে তাহার কাছে;
সাতটা ভাঙা পেন্সিল আর নীল বরণের ভাঙা দু-খান কাঁচ,
মারবেল আছে তিন-চারটে, কড়ি আছে গণ্ডা কি পাঁচ
ডলি পুতুল, মিনি পুতুল, কাঠের পুতুল, মাটির পুতুল আর-
পুঁতির মালা, রঙিন ঝিনুক, আরও অনেক খেলনা আছে তার
আছে তাহার পাতার বাঁশি, টিনের উনুন, শোলার পাখির ছা
সাতটা আছে ঝুমঝুমি তার আর আছে তার একটি খেলার মা



পল্লীবর্ষা
জসীমউদ্দিন
আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়িছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে,
কেয়া-বন-পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জলধারে।
কাহার ঝিয়ারি কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে-মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়
কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জলধারা,
তারি স্রোতে আজ শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া।
হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি,
নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোনো দিঠি!
চিঠির ওপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন-বাটে,
না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন-ঘাটে!
কোন সে বিরল বুনো ঝাউ-শাখে বুনিয়া গুলাবি শাড়ি-
হয়তো আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি!
এদিকে দিগন্তে যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল,
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল।
গাঁয়ের চাষিরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,
গল্পে গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে বাখারি চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রশি
কেউবা নতুন দোয়াড়ির গায়ে চাকা বাঁধে কসি কসি।
কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল,
কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল।
মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটির সুরে
আমির সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।
লাঠির ওপরে, ফুলের ওপরে আঁকা হইতেছে ফুল,
কঠিন কাঠ সে সারিন্দা হয়ে বাজিতেছে নির্ভুল।
তারি সাথে সাথে গল্প চলেছে, আমির সাধুর নাও
বহু দেশ ঘুরে আজিকে আবার ফিরিয়াছে নিজ গাঁও।
ডাব্বা হুঁকাও চলিয়াছে ছুটি এর হাতে ওর হাতে,
নানান রকম রশি বুনানও হইতেছে তার সাথে
বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ ডাকে,
সবের মাঝে রূপকথা যেন আর রূপকথা আঁকে।
যেন বৃদ্ধ, গাঁয়ের চাষিরা, আর ওই রূপকথা,
বাদলের সাথে মিশিয়া গড়িছে আরেক কল্পলতা।
বউদের আজ কোনো কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রশি,
সমুদ্রকলি শিকা বানাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।
কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী আখর টানি
আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে,
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে

প্রতিদান

জসীমউদদীন

আমার ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর
যে মোরে করিল পথের বিবাগী-
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি,
দিঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;
আমার ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর
আমার কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,
যে গেছে বুকে আঘাত করিয়া তার লাগি আমি কাঁদি
যে মোরে দিয়েছে বিষে-ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান,
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম-ভর,-
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর
মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ানো ফুল মালঞ্চ ধরি
যে মুখে কহে সে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে করে তারি মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত কীযে আনি সাজাই নিরন্তর-
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর

নিমন্ত্রণ-জসীম উদ্দিন
তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়
ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী,
পারের খবর টানাটানি করি-
বিনাসূতি মালা গাঁথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তীরের হিয়া
তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে- নরম ঘাসের পাতে,
চুম্বন রাখি অম্বরখানিরে মেজে লয়ো নিরালাতে
তেলাকুচ-লতা গলায় পরিয়া
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার পায়ের রঙখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে
তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গ করি
নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী
মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া,
তব সনে দেই মিতালি করিয়া,
ঢেলা কুড়াইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি
সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি
তুমি যদি যাওদেখিবে সেখানে মটর-লতার সনে,
সীম-আর-সীম হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেইখানে
তুমি যদি যাও সে-সব কুড়ায়ে,
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁয়ো চাষিদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব জনে জনে
তুমি যদি যাও- শামুক কুড়ায়ে, খুব-খুব বড় করে
এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে;
কারেও দেব না, তুমি যদি চাও
মনের খুশিতে দিয়ে দেব তাও,
গলায় পরিবে ঝুমঝুম রবে পথেরে মুখর করে,
হাসিব খেলিব গাহিব নাচিব সারাটি গেরাম ভরে
খুব ভোর করে উঠিতে হইবে, সুয্যি উঠারও আগে,
কারেও কবি না দেখিস পায়ের শব্দে কেহ না জাগে
রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে
ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;
কাদার বাঁধাল গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগেভাগে,
সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে
ভর দুপুরেতে একরাশ কাদা আর একরাশ মাছ,
কাপড়ে জাড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ;
'ওরে মুখ-পোড়া ওরে রে বাঁদর।'
গালি-ভরা মার অমনি আদর,
কতদিন আমি শুনি নারে ভাই, আমার মায়ের পাছ;
যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,
ঘন কালো বন-মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়
গাছের ছায়ায় বনের লতায়,
মোর শিশুকাল, লুকায়েছে হায়!
আজিকে সে-সব সরায়ে সরায়ে খুঁজিয়া লইব তায়,
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়

মামার বাড়িজসীম উদ্দিন

আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা,
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই।
মামার বাড়ি পদ্মপুকুর
গলায় গলায় জল,
এপার হতে ওপার গিয়ে
নাচে ঢেউয়ের দল।
দিনে সেথায় ঘুমিয়ে থাকে
লাল শালুকের ফুল,
রাতের বেলা চাঁদের সনে
হেসে না পায় কূল।
আম-কাঁঠালের বনের ধারে
মামা-বাড়ির ঘর,
আকাশ হতে জোছনা-কুসুম
ঝরে মাথারপর।
রাতের বেলা জোনাক জ্বলে
বাঁশ-বাগানের ছায়,
শিমুল গাছের শাখায় বসে
ভোরের পাখি গায়।
ঝড়ের দিনে মামার দেশে
আম কুড়াতে সুখ
পাকা জামের শাখায় উঠি
রঙিন করি মুখ।
কাঁদি-ভরা খেজুর গাছে
পাকা খেজুর দোলে
ছেলেমেয়ে, আয় ছুটে যাই
মামার দেশে চলে
জসীম উদদীন

রাখাল ছেলে
'রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও,
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?'
'ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা;
সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,
সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা
সেথায় যাব, ভাই এবার আমায় ছাড় না!'
রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! আবার কোথায় ধাও,
পূব আকাশে ছাড়ল সবে রঙিন মেঘের নাও'
'ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে
আমার সাথে করতে খেলা প্রভাত হাওয়া ভাই,
সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই
চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দু-খান পা,
বলছে ডেকে, 'গাঁয়ের রাখাল একটু খেলে যা!'
সারা মাঠের ডাক এসেছে, খেলতে হবে ভাই!
সাঁঝের বেলা কইব কথা এখন তবে যাই!'
'রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! সারাটা দিন খেলা,
যে বড় বাড়াবাড়ি, কাজ আছে যে মেলা!'
'কাজের কথা জানিনে ভাই, লাঙল দিয়ে খেলি
নিড়িয়ে দেই ধানের ক্ষেতের সবিজ রঙের চেলি
সরষে বালা নুইয়ে গলা হলদে হওয়ার সুখে
মটর বোনে ঘোমটা খুলে চুম দিয়ে যায় মুখে!
ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশি পঊষ-পাগল বুড়ি,
আমরা সেথা চষতে লাঙল মুর্শিদা-গান জুড়ি
খেলা মোদের গান গাওয়া ভাই, খেলা লাঙল-চষা
সারাটা দিন খেলতে জানি, জানিইনেকো বসা'

আসমানীজসীম উদ্দিন

আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে
পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের -খান হাড়,
সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার
মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি
থাপড়েতে নিবিয়ে দেছে দারুণ অভাব আসি
পরনে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,
সোনালি তার গা বরণের করছে উপহাস
ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,
সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি
বাঁশির মতো সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,
হয় নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে
আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে
ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল্-বিল্-বিল করে
ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,
সেই জলেতে রান্না-খাওয়া আসমানীদের চলে
পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,
বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর


রূপকথাআহসান হাবীব


খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে,
স্বপ্নের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে
এখানে রাতের ছায়া ঘুমের নগর,
চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের,
আকাশের নীল রং ছাউনিতে এর
পরীদের ডানা দিয়ে তৈরি দেয়াল,
প্রজাপতি রং মাখা জানালার জাল
তারা ঝিকিমিকি পথ ঘুমের দেশের,
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের
ছোট বোন পারুলের হাতে রেখে হাত,
সাতভাই চম্পার কেটে যায় রাত
কখনও ঘোড়ায় চড়ে হাতে নিয়ে তীর,
ঘুরে আসি সেই দেশ চম্পাবতীর
এই খানে আমাদের মানা কিছু নাই,
নিজেদের খুশি মত কাহিনী বানাই

জীবনের হিসাবসুকুমার রায়

বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই চড়ি শখের বোটে
মাঝিরে কন, “বলতে পারিস সূর্য কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফেলফেলিয়ে হাসে,
বাবু বলেন, “সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি!”
খানিক বাদে কহেন বাবু, “বলত দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় হতে নেবে?
বলত কেন লবন পোরা সাগর ভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, “আরে মশাই অত কি আর জানি?”
বাবু বলেন, “এই বয়সে জানিসনেও তা কি?
জীবনটা তোর নেহাত খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!”
আবার ভেবে কহেন বাবু, “বলত ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের চূড়ো?
বলত দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহন লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলেন, “আমায় কেন লজ্জা দিছেন হেন?”
বাবু বলেন, “বলব কি আর বলব তোরে কি, তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন নৌকাখানি ডুবল বুঝি দুলে।
মাঝিরে কন, “একি আপদ ওরে ভাই মাঝি,
ডুবল নাকি নৌকো এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, “সাতার জানো?” মাথা নারেন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, “মশাই এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে।
অতুলপ্রসাদ সেন
মোদের গরব, মোদের আশা
মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!
কি যাদু বাংলা গানে!- গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
এমন কোথা আর আছে গো!
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।।
ঐ ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা,
মরি হায়, হায় রে!

আছে কই এমন ভাষা, এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা!
বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন, হেম, মধু, বঙ্কিম,
নবীন-
আরও কত মধুপ গো!
ঐ ফুলেরি মধুর রসে, বাঁধলো সুখে মধুর বাসা।।
বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনলো মালা জগৎ জিনে-
গরব কোথায় রাখি গো!
তোমার চরণ-তীর্থে আজি, জগৎ করে যাওয়া-আসা
ওই ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে 'মা', 'মা' বলে;
ওই ভাষাতেই বলবো 'হরি', সাঙ্গ হলে কাঁদা-হাসা।।

বাংলা ভাষাআতুলপ্রসাদ সেন

মোদের গরব, মোদের আশা,
-মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে,
তোমার বোলে,
কতই শান্তি ভালোবাসা!
কি যাদু বাংলা গানে!
গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
গেয়ে গান নাচে বাউল,
গান গেয়ে ধান কাটে চাষা!
বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন্‌,
হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন-
ফুলেরই মধুর রসে,
বাঁধলো সুখে মধুর বাসা!
বাজিয়ে রবি তোমার বীণে,
আনলো মালা জগৎ জিনে!
তোমার চরণ-তীর্থে আজি,
জগৎ করে যাওয়া-আসা!
ভাষাতেই নিতাই গোরা,
আনল দেশে ভক্তি-ধারা,
আছে কৈ এমন ভাষা,
এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা?
ভাষাতেই প্রথম বোলে,
ডাকনু মায়েমা, মাবলে;
ভাষাতেই বলবো হরি,
সাঙ্গ হলে কাঁদা হাসা!
মোদের গরব, মোদের আশা,
-মরি বাংলা ভাষা!
আবদুল হাকিম

বঙ্গবাণী

কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ।।
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।

কাজী কাদের নেওয়াজ

শিক্ষকের মর্যাদা

বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি
শিক্ষক মৌলভী
ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি
দিল্লীপতির পুত্রের করে
লইয়াছে পানি চরণের পরে,
স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে
হঠাৎ কি ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না', যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না', ধারি না' ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে
তার পরদিন প্রাতে
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে
খাস কামরাতে যবে
শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, ''শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা''
শিক্ষক কন-''জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?''
বাদশাহ্ কহেন, ''সেদিন প্রভাতে দেখিলাম
আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে চরণ
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না' কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে''
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
''আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর''
রোকনুজ্জামান খান

গাধার কান

একটা দড়ির দুদিক থেকে টানছে দুদল ছেলে
তাই না দেখে বনের বানর লাফায় খেলা ফেলে
সকল বানর ফন্দি আঁটে জবর মজার খেলা
এমন খেলা খেলেই সবাই কাটিয়ে দেব বেলা
কিন্তু দড়ি মিলবে কোথায়? ঘাবড়ে গেল মাথা
পালের সেরা বানর বলে মগজ তোদের যা-তা
নেইকো দড়ি বয়েই গেল ভাবিস মিছে হাবা
লেজে লেজে ধরব টেনে হবে দড়ির বাবা
যেইনা বলা দুদল বানর দুদিক থেকে বসে
একের লেজটি ধরল টেনে জোরসে চেপে কষে
বনের গাধা দাঁড়ায় মাঝে উঁচিয়ে দু'টি কান
বলে, আমার দুদিক থেকে কান ধরে দে টান
কান ধরে এই মাথা নিবি আপন দলে টেনে
জিতবি তবে এই খেলাতে, রাখিস সবাই জেনে
অমনি দুদল হেঁইয়ো টানে- গাধার বিপদ ভারি
কান ছিঁড়ে সব হুমড়ি খেয়ে পড়ল সারি সারি
সাঙ্গ হল দড়ির খেলা বানররা সব হাসে
কান হারিয়ে গাধা শুধুই চোখের জলে ভাসে।

কালী প্রসন্ন ঘোষ

পারিব না
পারিব না কথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাব এক বার,
পাঁচজনে পারে যাহা,
তুমিও পারিবে তাহা,
পার কি না পার কর যতন আবার
এক বারে না পারিলে দেখ শত বার
পারিব না বলে মুখ করিও না ভার,
কথাটি মুখে যেন না শুনি তোমার,
অলস অবোধ যারা
কিছুই পারে না তারা,
তোমায় তো দেখি নাক তাদের আকার
তবে কেন পারিব না বল বার বার?
জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়,
সাঁতার শিখিতে হলে
আগে তব নাম জলে,
আছাড়ে করিয়া হেলা, হাঁট বার বার
পারিব বলিয় সুখে হও আগুয়ান


স্বর্ণকুমারী দেবী

উপদেশ
বড়লোক যদি তুমি হতে চাও ভাই,
ভালো ছেলে তাহা 'লে আগে হওয়া চাই
মন দিয়ে, পড় লেখো
সুজন হইতে শেখ,
খেলার সময় রেখ, তাতে ক্ষতি নাই
পিতামাতা গুরুজনে দেবতুল্য জানি,
যতনে মানিয়া চল তাঁহাদের বাণী
ভাইটি করেছে দ্বন্দ্ব,
বোনটি বলেছে মন্দ,
ক্রোধে হয়ো না কো অন্ধ, স্নেহে ধর পাণি
প্রতিবাদী দাসদাসী আত্মীয় স্বজন,
ভালোবাসি সবে কহ সুমিষ্ট বচন
দিও না কাহারে দুখ,
অন্যে দান করি সুখ,
নিজেরে মানোগো সুখী, বালক সুজন
জগতের সৃষ্টিকর্তা যিনি ভগবান,
যাঁহা হতে হইতে পাইয়াছ সুখ-শান্তি প্রাণ;
তাঁর কাজে সঁপি মন,
তাঁরে স্মরি অনুক্ষণ,
মাগিয়া মঙ্গল, তাঁর কর নাম-গান

গোলাম মোস্তফা

প্রার্থনা

অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি
বিচার দিনের স্বামী
যত গুণগান হে চির মহান
তোমারি অন্তর্যামী
দ্যুলোক-ভূলোক সবারে ছাড়িয়া
তোমারি চরণে পড়ি লুটাইয়া
তোমারি সকাশে যাচি হে শকতি
তোমারি করুণাকামী
সরল সঠিক পূণ্য পন্থা
মোদের দাও গো বলি,
চালাও সে-পথে যে-পথে তোমার
প্রিয়জন গেছে চলি
যে-পথে তোমার চির-অভিশাপ
যে-পথে ভ্রান্তি, চির-পরিতাপ
হে মহাচালক,মোদের কখনও
করো না সে পথগামী

কামিনী রায়

পাছে লোকে কিছু বলে

করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,-
পাছে লোকে কিছু বলে
আড়ালে আড়ালে থাকি
নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
পাছে লোকে কিছু বলে
হৃদয়ে বুদবুদ মত
উঠে চিন্তা শুভ্র কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
পাছে লোকে কিছু বলে
কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি
সযতনে শুকায়ে রাখি;-
নিরমল নয়নের জলে,
পাছে লোকে কিছু বলে
একটি স্নেহের কথা
প্রশমিতে পারে ব্যথা,-
চলে যাই উপেক্ষার ছলে,
পাছে লোকে কিছু বলে
মহৎ উদ্দেশ্য যবে,
এক সাথে মিলে সবে,
পারি না মিলিতে সেই দলে,
পাছে লোকে কিছু বলে
বিধাতা দেছেন প্রাণ
থাকি সদা ম্রিয়মাণ;
শক্তি মরে ভীতির কবলে,
পাছে লোকে কিছু বলে
যোগীন্দ্রনাথ সরকার

মজার দেশ
এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো
আকাশ সেথা সবুজবরণ গাছের পাতা নীল;
ডাঙ্গায় চরে রুই কাতলা জলের মাঝে চিল!
সেই দেশেতে বেড়াল পালায়, নেংটি-ইঁদুর দেখে;
ছেলেরা খায় 'ক্যাস্টর-অয়েল'- রসগোল্লা রেখে!
মণ্ডা-মিঠাই তেতো সেথা, ওষুধ লাগে ভালো;
অন্ধকারটা সাদা দেখায়, সাদা জিনিস কালো!
ছেলেরা সব খেলা ফেলে বই নে বসে পড়ে;
মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া লোকের পিঠে চড়ে !
ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই, উড়তে থাকে ছেলে;
বড়শি দিয়ে মানুষ গাঁথে, মাছেরা ছিপ ফেলে !
জিলিপি সে তেড়ে এসে, কামড় দিতে চায়;
কচুরি আর রসগোল্লা ছেলে ধরে খায়!
পায়ে ছাতি দিয়ে লোকে হাতে হেঁটে চলে!
ডাঙ্গায় ভাসে নৌকা-জাহাজ, গাড়ি ছোটে জলে!
মজার দেশের মজার কথা বলবো কত আর;
চোখ খুললে যায় না দেখা মুদলে পরিষ্কার

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

মানুষ জাতি

জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
সে জাতির নাম মানুষ জাতি;
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
একই রবি শশী মোদের সাথী
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা
সবাই আমরা সমান বুঝি
কচি কাঁচাগুলি ডাঁটো করে তুলি
বাঁচিবার তরে সমান যুঝি
দোসর খুঁজি বাসর বাঁধি গো,
জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙা,
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
ভিতরে সবারই সমান রাঙা
বাহিরের ছোপ আঁচড়ে সে লোপ
ভিতরের রং পলকে ফোটে,
বামুন, শুদ্র, বৃহৎ ক্ষুদ্র
কৃত্রিম ভেদ ধূলায় লোটে
বংশে বংশে নাহিক তফাত
বনেদি কে আর গর-বনেদি,
দুনিয়ার সাথে গাঁথা বুনিয়াদ
দুনিয়া সবারি জনম-বেদী
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

ফুলের ফসল

জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি'
দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার
ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!
বাজারে বিকায় ফল তণ্ডুল
সে শুধু মিটায় দেহের ক্ষুধা,
হৃদয়-প্রাণের ক্ষুধা নাশে ফুল
দুনিয়ার মাঝে সেই তো সুধা!
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

কোন্ দেশে

কোন্ দেশেতে তরুলতা
সকল দেশের চাইতে শ্যামল?
কোন্ দেশেতে চলতে গেলেই
দলতে হয় রে দুর্বা কোমল?
কোথায় ফলে সোনার ফসল,
সোনার কমল ফোটেরে?
সে আমাদের বাংলাদেশ,
আমাদেরই বাংলা রে!
কোথায় ডাকে দোয়েল-শ্যামা
ফিঙে নাচে গাছে গাছে?
কোথায় জলে মরাল চলে,
মরালী তার পাছে পাছে?
বাবুই কোথা বাসা বোনে,
চাতক বারি যাচে রে?
সে আমাদের বাংলাদেশ,

আমাদেরই বাংলা রে!

No comments:

Post a Comment